বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনের আগে রাজপথে কট্টর জামায়াতে ইসলামীর কদর্য সংঘাতের ঘটনায় প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ শিবিরের দিকে ঝুঁকতে হয় ভারতকে। যদিও ২০১২ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নয়াদিল্লি সফরে ভারতের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ সম্প্রতি তাঁর প্রকাশিত ‘দ্য আদার সাইড অব দ্য মাউন্টেইন’ বইতে এসব কথা বলেছেন। সালমান খুরশিদ কংগ্রেস পার্টির নীতি নির্ধারকদের মধ্যে অন্যতম। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাই-টেড প্রোগেসিভ এলায়েন্স (ইউপিএ) জোট সরকারের সর্বশেষ দুই মেয়াদে (২০০৪-২০১৪) তিনি মন্ত্রিসভার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলেছেন। সর্বশেষ ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। তাঁর লেখা বইতে উঠে এসেছে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর জানা এমন অনেক গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা পরবর্তীতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এমনকি এর মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র নীতিও যুক্ত রয়েছে। তাঁর বইতে উঠে এসেছে ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের কেন ভরাডুবি হয়েছিল। একইসঙ্গে উঠে এসেছে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতিতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের গৃহীত কিছু ভুল পদক্ষেপের কথাও। এসব ইস্যুতে সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করলেও তাঁর তত্কালীন কোনো সহকর্মীকে দোষারোপ করেননি। তাঁর বইতে উঠে এসেছে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তত্কালীন সরকারের পররাষ্ট্র-নীতির টুকিটাকিও। সালমান খুরশিদ ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে ১৮ মাস পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ভারতের। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁকে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উপর গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন। তিনি বইতে লিখেছেন, পররাষ্ট্র নীতিতে কাজ করতে তাঁকে বিস্তৃত সুযোগ দেয়া হয়েছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে। তিনি বইতে বলেন, ভারতে সাধারণ একটি ধারণা হলো বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের ঐতিহ্যগতভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে দুই দেশের সম্পর্ক গতি পেয়েছে। এর পেছনে ঐতিহাসিক কারণও আছে। সেটা হলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দল ক্ষমতায় আসলে ভারত তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেনি। দুই দেশের নেতৃত্বের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ঠিকই কিন্তু কূটনীতি সবসময় নির্ভর করে জাতীয় স্বার্থের উপর কারো ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের উপর নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি যখন প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কাজ করতে মনোনিবেশ করেছিলেন তখন তাঁর জন্য প্রথম বড় চ্যালেঞ্জের কাজ ছিল ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নয়াদিল্লি সফর। বইতে সালমান খুরশিদ লিখেছেন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণার কাছ থেকে দায়িত্ব নেয়ার মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে খালেদা জিয়া ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিথি হিসেবে ভারত সফর করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তিক্ত রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে তখন তাঁরা কত দক্ষভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক সামলে ছিলেন সে কথা তুলে ধরেছেন তিনি। খুরশিদ বইতে লিখেছেন, অল্প সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমার উষ্ণ ব্যক্তি সম্পর্ক তৈরি হয় এবং আজমির শরিফ জিয়ারতের পর নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আমি তাঁর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এই সাক্ষাত্ পেতে বেগম জিয়া খুবই উদগ্রীব ছিলেন। যদিও এই সাক্ষাতের কারণে শেখ হাসিনার সঙ্গে আমাদের যে চমত্কার সম্পর্ক রয়েছে তাতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না তা নিয়ে আমাদের অনেক সতর্কভাবে হিসাব-নিকাশ করতে হয়েছিল। তবে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির যে দীর্ঘ দিন ধরে সুসম্পর্ক রয়েছে সেটা ভারতের রাজনৈতিক মহলের জানা বিষয়। সালমান খুরশিদ বইতে আরো লিখেছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুভূত হয়েছিল যে, আমরা একটি সাফল্য আনতে পেরেছি এবং খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বরফ গলেছে। যদিও এর আগে আমাদের সম্পর্ক অনেকটাই শীতল ছিল। কয়েক মাস পর বাংলাদেশ সফরকালে খালেদা জিয়া আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নের পর এই বিষয়টি নিশ্চিত হয়। এমনকি খালেদা জিয়া বিরলভাবে আমাকে বিদায় জানিয়েছিলেন এবং বাইরে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে রাজপথে একদিকে সরকার সমর্থক ও তরুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী জাতীয়তাবাদী (গণজাগরণ মঞ্চ) এবং অন্যদিকে কট্টর জামায়াতে ইসলামীর কদর্য সংঘাতের ঘটনায় প্রাথমিক সেসব ইতিবাচক লক্ষণগুলো গুলিয়ে যায়। আর সে সময় আমাদেরকে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ শিবিরের দিকে ঝুঁকতে হয়। ভারতের এটি বেছে নিতেই হয়েছে। এক্ষেত্রে অবস্থান নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া এবং সেজন্য সুযোগ হারানোটা সত্যিই বিপজ্জনক ছিল। তিনি বইতে লিখেছেন, নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর এবং ছিটমহল বিনিময়। কিন্তু এক বছর পর ২০১৫ সালের জুনে যখন ছিটমহল বিনিময় হলো তখন কংগ্রেস ক্ষমতার বাইরে। আর তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি এখনো ঝুলে রয়েছে যদিও ভারতের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে।
উৎসঃ ইত্তেফাক
No comments